চতুর্থ অধ্যায়
দান
'দান' একটি মহৎ মানবীয় গুণ। নিঃস্বার্থভাবে যা দেয়া হয় তা-ই দান। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে অপরের উপকারের জন্য যিনি দান কার্য সম্পাদন করেন, তিনি একজন মহৎ ব্যক্তি। বৌদ্ধধর্মে দানের গুরুত্ব অপরিসীম। দান পারমী পূর্ণ না করলে নির্বাণ লাভ সম্ভব নয়। তথাগত বুদ্ধ 'বুদ্ধত্ব' লাভের জন্য দশ পারমীর মধ্যে দান পারমীকেই প্রথম স্থান দিয়েছেন। ধনীরাই দান করতে পারেন তা নয়, চিত্তের উদারতা থাকলে গরিবরাও দান করতে পারে। অনেক বিত্তহীন ব্যক্তি শুধু চিত্তের উদারতার কারণে দান করে মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দান করার ক্ষেত্রে পাত্র অপাত্র, দানীয় বস্ত্র ও মানসিক অবস্থা প্রভৃতি বিবেচনা করতে হয় । দান একটি কুশল কর্ম । অন্যান্য কুশল কর্মের মতো দানেরও সুফল বা প্রভাব আছে। এ অধ্যায়ে আমরা দানের বিবেচ্য বিষয়, তিনটি দান কাহিনী এবং দানের প্রভাব সম্পর্কে পড়ব
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
* বৌদ্ধ দান কাহিনী বর্ণনা করতে পারব।
* দানের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় উল্লেখ করতে পারব।
* দানের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে পারব।
পাঠ : ১
দানের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়
কর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করতে হয়। তাই কোনো কাজ করার পূর্বে কর্মফল সম্পর্কে চিন্তা করা উচিত। বৌদ্ধধর্মে নিঃস্বার্থভাবে কোনো কিছু ত্যাগ করলেই দান হয় না, দান দিতে হলে দানীয় বস্তু, দাতা ও দানের ক্ষেত্র বা গ্রহীতার বিষয়ে বিবেচনা করতে হয়। দানের বিবেচ্য বিষয়গুলো নিচে সংক্ষিপ্তভাবে জানব
বৌদ্ধধর্মে দানীয় বস্তুর ক্ষেত্রে প্রধানত তিনটি বিষয় বিবেচনা করতে হয়। যথা : ১। বস্তু সম্পত্তি ২। চিত্ত সম্পত্তি ৩। প্রতিগ্রাহক সম্পত্তি।
১। বস্তু সম্পত্তি
বৌদ্ধধর্মে সৎ-উপায়ে অর্জিত বা লব্ধ টাকা-পয়সা বা বস্তুকে বস্তু সম্পত্তি বলা হয়। অর্থাৎ দানীয় বস্তুটি ন্যায়সম্মতভাবে অর্জিত হয়েছে কিনা তা বিবেচনা করা। অসদুপায়ে লব্ধ টাকা-পয়সা বা বস্তু দান করা উচিত নয় । এরূপ দানকে মিশ্রদান বলে। মিশ্রদান হীন দান দানীয় বস্তু তিন প্রকার । যথা : আমিষ দান, অভয় দান ও ধর্ম দান। আমিষ দান দুই প্রকার বাহিরের বস্তু ও ভিতরের বস্তু । বাহিরের বস্তু হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, পানীয়, বাসস্থান, পরিষ্কার করার জিনিস, ধুপ, বাতি, যানবাহন,বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
ঔষধ, বাড়ি, প্রাসাদ, কুটির, বিহার ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু। ভিতরের বস্তু হচ্ছে নিজের হাত, পা, চোখ, কিডনি, হৃৎপিণ্ড, রক্ত, চর্ম ইত্যাদি যা গ্রহীতার নিশ্চয়ই উপকারে আসবে জেনে দাতা দান করে থাকেন। হিংসার বশবর্তী হয়ে ক্ষতি করার জন্য যদি কেউ দানীয় বস্তুগুলো প্রার্থনা করে তখন তা দান করা উচিত নয়।
অভয় দান অভয় দান হল নিরাশ্রয়, বিপদাপন্ন, অসহায় মানুষ ও প্রাণীকে আশ্রয়, নির্ভরতা, সেবা প্রভৃতি দান করা যাতে সে নিরাপদ হয়।
ধর্ম দান ধর্ম দান হল মৈত্রী দান, পুণ্য দান, জ্ঞান দান প্রভৃতি। ধর্ম দান অর্থাৎ নৈতিকতার পথে আসতে সাহায্য করা।
বৌদ্ধধর্মে দান করার ক্ষেত্রে বস্তু সম্পত্তি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা উচিত ।
২। চিত্ত সম্পত্তি ।
বুদ্ধ চেতনাকে কর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। চিত্তের কুশল চেতনা কুশল কর্ম, অকুশল চেতনা অকুশল কর্ম হিসেবে অভিহিত । চেতনায় কুশল কর্ম যত চিন্তা করা যায়, ততই পুণ্য বৃদ্ধি পায়। দান দেয়ার পূর্বে সন্তুষ্ট চিত্ত থাকা, দান দিয়ে চিত্তকে প্রসন্ন করা এবং দেয়ার পরও চিত্তে অপার আনন্দ উৎপন্ন করা একান্ত প্রয়োজন । তাই দান দেয়ার পূর্বে, দান দেয়ার সময় এবং দান দেয়ার পর চিত্ত লোভ-দ্বেষ-মোহ মুক্ত থাকা এবং কুশল চেতনা যুক্ত থাকা উচিত। তাই বুদ্ধের উপদেশ স্মরণ করে অতি শান্ত ও পবিত্র মনে উদার চিত্তে দান করা উত্তম।
দানের ক্ষেত্রে যিনি কুশল চিত্তে দান করেন শুধু তিনিই যে পুণ্য ফল অর্জন করেন তা নয়, অন্যরা যাঁরা ঐ দান অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা ও উদার চিত্তে অংশগ্রহণ করেন এবং সাধুবাদের সঙ্গে দান অনুমোদন করেন তাঁরাও পুণ্যফল অর্জন করেন। দান চর্চার বিষয়। ধন-সম্পদ থাকলেও সবাই দান করতে পারে না। এর কারণ চিত্তের উদারতা ও কুশল চেতনার অভাব। চিত্তের এই অবস্থাকে চিত্তসম্পত্তি বলা হয়। প্রত্যেকের দান অনুশীলন করা উচিত।
৩। প্রতিগ্রাহক সম্পত্তি :
বৌদ্ধধর্ম মতে, দানের ফল নির্ভর করে দান গ্রহীতার চারিত্রিক শুদ্ধিতার উপর। তাই দান দেয়ার পূর্বে দান গ্রহীতা সম্পর্কেও বিচার বিবেচনা করা উচিত। বিবেচনা না করে দান দিলে উল্টো ফলও হতে পারে। যেমন, যদি একজন নিষ্ঠুর ডাকাতকে অর্থ দান করা হয়, সে তা দিয়ে মারণাস্ত্র কিনে মানুষ হত্যা করতে পারে। এমনকি দাতাকেও হত্যা করতে পারে। তাই দান গ্রহীতা সম্পর্কে বিবেচনা করে দান দেয়া উচিত। দান গ্রহণের উপযুক্ত পাত্রকে প্রতিগ্রাহক সম্পত্তি বলা হয় ।
দানের ক্ষেত্রে সময় ও গ্রহীতার সঠিক প্রয়োজনও বিবেচনা করা উচিত। গ্রহীতার প্রয়োজন বিবেচনা করে দান করলে সেই দানকে 'কালদান' বলা হয়। গ্রহীতার প্রয়োজন অনুসারে দান করলে এতে দাতা ও গ্রহীতা উভয়েই উপকৃত হয় বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘ হচ্ছে দানের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত পাত্র। বুদ্ধ বর্তমান থাকলে তাঁকে দান করলে সর্বোৎকৃষ্ট ফল লাভ করা যায়। সদ্ধর্মের প্রচার-প্রসারে দান করলে তা উৎকৃষ্ট দান হয়। কারণ সদ্ধর্ম মানুষকে নৈতিক ও দুঃখ মুক্তির পথে পরিচালিত করে। শীলবান ভিক্ষুসংঘও দানের উত্তম পাত্র। শীলবান ভিক্ষুগণ সদ্ধর্মের ধারক-বাহক। এছাড়া শীলবান অথচ ভিক্ষু নন এমন ব্যক্তিকেও তাঁর উপকারার্থে দান করা যায়। পশু, পাখি, সরীসৃপ, পোকা ইত্যাদিকেও দান করা যায়। স্বর্গ ও নরকবাসী মৃত জ্ঞাতিগণের উদ্দেশে দান করা যায়। এই দানেও শতসহস্র গুণ পুণ্যফল অর্জিত হয়।
দাতা ও গ্রহীতা
কোনো কোনো দান দাতার দ্বারা মহাফলপ্রদ হয় অথচ গ্রহীতার দ্বারা হয় না। আবার কোনো কোনো দান গ্রহীতার দ্বারা মহাফলপ্রদ হয়, কিন্তু দাতার দ্বারা হয় না। কোনো কোনো দান দাতা ও গ্রহীতা কোনো পক্ষের দ্বারা মহাফলপ্রদ হয় না। আবার কোনো কোনো দান দাতা ও গ্রহীতা উভয় পক্ষের দ্বারা মহাফলপ্রদ হয়।
শীলবান দায়ক যদি দুঃশীল গ্রহীতাকে দান করে, তা দায়কের শীলগুণ প্রভাবে মহাফলপ্রদ হয় । শীলবান রাজা বেস্সান্তর যেমন যোজক ব্রাহ্মণকে দান দিয়ে পৃথিবী কম্পিত করেছিলেন। দুঃশীল দায়ক যদি শীলবান গ্রহীতাকে দান করে, তা গ্রহীতার দ্বারা মহাফলপ্রদ হলেও দায়কের দ্বারা নহে। দাতা গ্রহীতা উভয়ে দুঃশীল হলে সেই দান কোনো পক্ষ হতেই মহাফলদায়ী হয় না। দাতা- গ্রহীতা উভয়ে যদি শীলবান হয়, তবে উভয়পক্ষের শীলগুণে সেই দান মহাফলপ্রদ হয়ে থাকে । এজন্যই দান সম্পর্কে শাস্ত্রে বলা হয়-
যো সীলবা সীলবন্তেসু দদাতি দানং
ধম্মেন লক্ষং সুপ্রসন্ন চিত্তো
অভিসন্ধহং কৰ্ম্মফলং উলারং
তবে দানং বিপুল ফলন্তি ক্রমি
বাংলা অনুবাদ যে শীলবান ধর্ম দ্বারা উপার্জিত বস্তু উদার কর্মফল শ্রদ্ধাসহ সুপ্রসন্ন চিত্তে শীলবানকে দান দিয়ে থাকে, আমি বলি, সে দান নিশ্চয়ই বিপুল ফল প্রদান করে থাকে (কারণ তা দায়ক ও প্রতিগ্রাহক উভয়ের শীল গুণ দ্বারা বিশুদ্ধ)।
অনুশীলনমূলক কাজ
দানের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলো উল্লেখ করো। দানীয়বস্তুর একটি তালিকা তৈরি করো। 'কালদান' কাকে বলে ।
পাঠ : ২ দান কাহিনি
কাহিনি : ১
গৌতম বুদ্ধ পূর্বজন্ম স্মরণ করতে পারতেন। শিষ্য এবং উপাসকদের উপদেশ দেওয়ার সময় তিনি প্রায়ই তাঁর পূর্বজন্মের কুশল কর্মের নানা কাহিনি বর্ণনা করতেন। এই কাহিনিগুলো জাতক নামে পরিচিত জন্ম-জন্মান্তরে বুদ্ধ হওয়ার জন্য তিনি নানা কুলে জন্মগ্রহণ করে পারমীসমূহ পূর্ণ করেছিলেন। প্রতিটি জন্মে তিনি বোধিসত্ত্ব নামে অভিহিত। বোধিসত্ত্ব অবস্থায় তিনি অনেক দান করেছেন। বৌদ্ধ সাহিত্যে বোধিসত্ত্বের অনেক দান কাহিনি আছে। এখন এরূপ একটি দান কাহিনি পড়ব
একবার বারানসিরাজ ব্রহ্মদত্তের সময়ে বোধিসত্ত্ব দরিদ্রকূলে জন্মগ্রহণ করেন। তখন তিনি এক শ্রেষ্ঠীর বাড়িতে দিন মজুর হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একদিন তিনি চারটি সিদ্ধ যব কিনে নিয়ে কাজে যাচ্ছিলেন। ঐ সিদ্ধ যবগুলো ছিল তাঁর খাদ্য। কাজে যাওয়ার পথে তিনি চারজন প্রত্যেকবুদ্ধের দেখা পেলেন। তাঁরা ভিক্ষান্ন সংগ্রহে বের হয়েছিলেন। প্রত্যেকবুদ্ধগণ শীলবান ছিলেন। তাঁদের দেখে বোধিসত্ত্ব সিদ্ধ যবগুলো দান দেবেন বলে স্থির করলেন । তিনি তখন তাঁদের বন্দনা করে দানের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। দাতার আগ্রহ দেখে প্রত্যেক বুদ্ধগণ দান গ্রহণে সম্মত হলেন। বোধিসত্ত্ব পরিষ্কার স্থানে চারটি আসন প্রস্তুত করে তাতে বুদ্ধগণের বসার ব্যবস্থা করলেন এবং স্বহস্তে সিদ্ধ যবগুলো তাঁদের আহারের জন্য দান করলেন। প্রত্যেক বুদ্ধগণ দান অনুমোদন করলেন। দান অনুমোদনের পরে বোধিসত্ত্ব প্রত্যেকবুদ্ধগণের নিকট প্রার্থনা করলেন যে, এই দানের ফলে তিনি যেন পরবর্তী জন্মে দরিদ্র ঘরে জন্মলাভ না করেন। প্রত্যেকবুদ্ধগণ প্রার্থনা অনুমোদন করে আশীর্বাদ করলেন। বোধিসত্ত্ব দানজনিত প্রীতি অনুভব করলেন ।
বোধিসত্ত্ব যতদিন বেঁচেছিলেন ততোদিন এই দানের কথা স্মরণ করতেন। মৃত্যুর পর তিনি বারানসির রাজার পুত্ররূপে পুনরায় জন্মলাভ করেন। তখন তাঁর নাম হয় ব্রহ্মদত্ত কুমার। বড় হয়ে তিনি তক্ষশীলায় গিয়ে সর্ববিদ্যায় পারদর্শীতা অর্জন করলেন । পিতার মৃত্যুর পরে তিনি রাজপদে অধিষ্ঠিত হলেন।
বোধিসত্ত্ব রাজা হয়ে কোশল রাজার পরমা সুন্দরী কন্যাকে অগ্রমহিষী করলেন। এই অগ্রমহিষী পূর্বজন্মে শীলবর্তী নারী ছিলেন। দাসীবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করলেও তিনি সচ্চরিত্র সম্পন্ন ছিলেন। একদিন তিনিও বৌদ্ধ ভিক্ষুকে নিজের খাদ্য সন্তুষ্ট চিত্তে আনন্দের সঙ্গে দান করেছিলেন। সেই দানফলে তিনি পরজন্যে কোশল রাজকন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পরে বারানসিরাজ ব্রহ্মদত্তের অগ্রমহিয়ষীর পদ লাভ করেন। রাজা ও রানি উভয়েই অত্যন্ত দানশীল ছিলেন এবং ছয়টি দানশালা স্থাপনের মাধ্যমে তাঁরা দান কর্ম করতেন।
দান
৩৫
অনুশীলনমূলক কাজ গল্পে বর্ণিত দান কাহিনীর বিশেষত্ব চিহ্নিত করো।
কাহিনী : ২
রাজা বেস্সান্তর অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। একবার একজন দুঃশীল পাপী ব্রাহ্মণ তাঁর দানধর্ম পরীক্ষা করার জন্য তাঁর সন্তানদের ভিক্ষা চাইলেন। শীলবান রাজা বেস্সান্তর উদার ও প্রসন্ন চিত্তে পাপী ব্রাহ্মণকে ছেলে-মেয়ে দান করেছিলেন। তাঁর এই দানের মহীমায় পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল। রাজা বেস্সান্তর দুঃশীল যোজক ব্রাহ্মণের অকুশল বাসনা সম্পর্কে জানতেন না। তিনি রাজাকে প্রবঞ্চনা করতে এসেছিলেন। কিন্তু শীলবান রাজা তাঁর উদার দানধর্ম থেকে বিরত হননি। তিনি নিজের জীবনের চেয়ে প্রিয় সন্তানদের দুঃশীল ব্রাহ্মণের হাতে দান করলেন। ব্রাহ্মণ যখন সন্তানদ্বয়কে নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করলেন তখন হঠাৎ রক্তবমি করতে লাগলেন এবং ঐখানেই প্রাণ ত্যাগ করলেন। রাজা সন্তানদের ফিরে পেলেন। তাঁর দানের মহত্ব বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, উদার ও প্রসন্ন চিত্তে শ্রদ্ধার সঙ্গে দুঃশীল ব্যক্তিকে দান করলে সেই দান দাতার গুণ দ্বারা বিশুদ্ধতা প্রাপ্ত হয় বিশুদ্ধতা প্রাপ্তি অর্থ মহাফলদায়ক যা মহা পুণ্য লাভের কারণ ।
রাজা বেস্সান্তর ব্রাহ্মণকে সন্তান দান করছেন ৩৬
বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা
কাহিনি : ৩
কল্যাণ নদীর তীরে বসবাস করত এক জেলে। নদীর মাছ শিকার করে সে জীবিকা নির্বাহ করত। এই জেলে দীর্ঘসোম স্থবির নামে একজন শীলবান ভিক্ষুকে তিনবার পিণ্ডদান করেছিলেন। শেষ জীবনে এবং মৃত্যুর সময়েও ঐ জেলে তাঁর দানময় অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করতেন। তিনি চিন্তা করতেন, “আমি আর্য দীঘসোম স্থবিরকে যে পিণ্ডদান দিয়েছিলাম তা আমার অনেক পুণ্য অর্জনের এবং পাপ ক্ষয়ের কারণ হয়েছে।" এই দান ও কুশল কর্মের চেতনার ফলে তিনি অনেক পুণ্যফল অর্জন করেছিলেন। এক্ষেত্রে প্রতিগ্রাহকের গুণে দান মহাফল প্রদান করেছে।
অনুশীলনমূলক কাজ
দান কাহিনি ২ এবং ৩-এর শিক্ষণীয় বিষয় আলোচনা করো।
পাঠ : ৩
দানের প্রভাব
দানের প্রভাব অপরিসীম। সংঘদান, অষ্ট পরিষ্কার দান ও কঠিন চীবর দান ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা সমবেতভাবে শীলময়, দানময় ও ভাবনাময় চিত্তে পূজনীয় ভিক্ষুসংঘকে দান করে থাকি । দান ব্যক্তি, সমাজ এবং ধর্মীয় জীবনের উৎকর্ষতা সাধন করে। নিম্নে ব্যক্তি, সমাজ এবং ধর্মীয় জীবনে দানের প্রভাব আলোচনা করা হলো।
ব্যক্তি জীবনে দানের প্রভাব দান মানুষের মানবিক ও নৈতিক গুণাবলির বিকাশ সাধন করে। দান দ্বারা লোভ-দ্বেষ- মোহ যেমন বিদুরিত হয়, তেমনি মৈত্রী, করুণা, পরোপকারী মনোভাব, সহমর্মিতা ও দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি হয়। এসব গুণাবলির অধিকারী ব্যক্তি মহৎ কর্ম সম্পাদন করতে পারেন। ফলে আত্মতুষ্টি ও আনন্দ লাভ করেন সর্বত্র প্রশংসিত ও পূজিত হন। তাঁর কীর্তি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ভালো বন্ধু লাভ করেন। কখনো বিপদ ও অভাব গ্রস্থ হন না।
সমাজ জীবনে প্রভাব দানশীল ব্যক্তির দান দ্বারা সমাজে অনেক কল্যাণ সাধিত হতে পারে। বিদ্যালয়, হাসপাতাল, অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা, রাস্তাঘাট মেরামত ও উন্নয়ন, কন্যা দায়গ্রন্থ অভিভাবক ও মেধাবী শিক্ষার্থীকে সহায়তা, কর্মসংস্থানের উপায় সৃষ্টি, জলাধার স্থাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে দান করলে সমাজের উন্নয়ন ও বহুজনের উপকার সাধিত হয়। রক্ত দান, চোখ দান ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ জীবনযাপনে আশা জাগায়, দৃষ্টিহীনকে দৃষ্টি ফিরে পেতে সাহায্য করে। ধর্মীয় দানানুষ্ঠান সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করে । ফলে সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়।
ধর্মীয় জীবন গঠনে দানের প্রভাব নির্বাণ লাভ করতে হলে দশপারমী পূর্ণ করতে হয়। দশপারমীর মধ্যে দান পারমীর স্থান সর্বাগ্রে। লোভ দ্বেষ-মোহের কারণে তৃষ্ণা উৎপন্ন হয়। তৃষ্ণাই সকল দুঃখের মূল কারণ। তৃষ্ণার কারণে মানুষ বারবার জন্মগ্রহণ করে দুঃখ ভোগ করে। তৃষ্ণাকে ক্ষয় করতে পারলে দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করা সম্ভব। দানের ফলে লোভ-দ্বেষ-মোহ বিদূরিত হয়। তৃষ্ণার ক্ষয় হয়। তৃষ্ণা মুক্ত মানুষ আর জন্মগ্রহণ করেন না। ফলে মানুষ দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করে নির্বাণের পথে অগ্রসর হন। দান পারমী পূর্ণকারী ব্যক্তি স্রোতাপত্তি, সদাগামী, অনাগামী এবং অর্হত্ব ফল লাভ করেন। এভাবে দান ধর্মীয় জীবন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
Read more